আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে
ঢাকার পুরনো এক বাসা, বিকেলের মৃদু আলো জানালার ফাঁক গলে ঘরে পড়ছে। ফারহান আজ একটু তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরেছে। কারণ আজ তার ছেলের স্কুলে প্যারেন্টস-ডে ছিল। সেখানেই হঠাৎ এক শিক্ষক বললেন, “আপনার ছেলে তো বলে আপনি একটা বড় অফিসার, গাড়ি নিয়ে অফিসে যান!”
মৃদু হেসে মাথা নিচু করলেন ফারহান। তিনি জানেন, তিনি বড় অফিসার নন। তিনি একজন জুনিয়র অ্যাকাউন্টেন্ট—একটি মাঝারি মানের প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করেন, যেখানে মাস শেষে বেতন পাওয়াটাই এক বড় স্বস্তির বিষয়। গাড়ি? সেটা তারা কখনো কিনতে পারেননি। এখনো সিএনজি বা রিকশাতেই যাতায়াত।
২. মধ্যবিত্তের অদৃশ্য যুদ্ধ:
মধ্যবিত্ত মানেই যেন এক জীবনযুদ্ধের সৈনিক—না থাকে প্রাচুর্যের গর্ব, না থাকে দারিদ্র্যের সরলতা। তাদের জীবনটা একটা “না” আর “কীভাবে যেন” এর মাঝে আটকে থাকে। সন্তান যখন কিছু চায়, তখন বাবার মুখে “না” থাকলেও মন চায় “হ্যাঁ” বলতে। কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মাঝখানে যে এক অদৃশ্য দেয়াল দাঁড়িয়ে থাকে, সেটি সন্তান বুঝে না।
ফারহানের মতো লাখো বাবা-মা দিনের পর দিন নিজে ভালো কিছু না খেয়ে, পুরনো জামা পরে, অফিসে মিষ্টি হাসি নিয়ে বসে থাকেন, যেন কিছুই হয়নি। অথচ ভেতরে তারা জ্বলতে থাকেন, শুধুমাত্র একটি স্বপ্ন নিয়ে—“আমার সন্তান যেন থাকে দুধে-ভাতে।”
৩. ভুল কোথায়?
এই স্বপ্নটা সুন্দর, নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমরা যখন সন্তানকে “দুধে-ভাতে” রাখতে গিয়ে আমাদের জীবনসংগ্রামের ছায়াও তাদের গায়ে পড়তে দেই না, তখন তারা বড় হয়ে বাস্তবতা বুঝতেই শেখে না। তারা ভাবে টাকা যেন সহজে আসে, বাবা-মায়ের কাজটা তেমন কিছু না, আর তারা যা চায় তাই পাওয়াটা অধিকার।
এই ভুলটা আমাদের সমাজে একটি প্রজন্ম তৈরি করছে, যারা ভোগে অভ্যস্ত, সংগ্রামে অচেনা। তারা চাকরিতে একটু চাপ এলেই হতাশ হয়ে পড়ে, সংসার চালাতে গিয়ে মা-বাবার মত ত্যাগ করতে রাজি নয়, কারণ তারা কখনো শেখেনি যে জীবন মানেই ত্যাগ, মানিয়ে নেওয়া, এবং কঠোর পরিশ্রম।
৪. সন্তানের চোখে বাস্তবতা আনুন:
ফারহান এখন বুঝেছেন, তার ছেলে আর রূপকথার রাজপুত্র নয়—সে হবে একজন সচেতন মানুষ, যদি তাকে সত্যি কথা শেখানো যায়।
তাই ফারহান ছেলেকে নিয়ে এবার থেকে মাসে একবার বাজারে যান। তাকে দেখান কোন মাছটা কত টাকায় আসে, কোন চালটা ভালো কিন্তু সস্তা। মাঝে মাঝে তাকে বলেন, “এই মাসে বাজেট একটু টাইট, নতুন জুতা না কিনে পুরনোটা সামলাও।”
ছোট ছোট এই শিক্ষাই বড় হয়ে শিশুর মনে গড়ে তোলে মূল্যবোধ, সহমর্মিতা আর কৃতজ্ঞতা।
৫. শিক্ষার জায়গাটা পরিবারের ভিতরেই:
আমরা অনেকেই ভাবি, সন্তানকে স্কুলে পড়ালেই দায়িত্ব শেষ। কিন্তু সন্তান গড়ে ওঠে পরিবার থেকে—যেখানে বাবা নিজের বেতন পেয়ে হিসাব করে চাল-ডাল কিনে, মা পুরনো শাড়ি সেলাই করে নতুন বানায়। সন্তান যদি সেটা না দেখে, তাহলে তার শিক্ষা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।
আপনার সন্তানকে বুঝতে দিন, আপনি কিভাবে মাসের শেষে বিল মেটান, কেন আপনি মোবাইল ফোন বদলান না, কেন আপনার বাসায় এখনো এসি নেই। এতে সে বোঝে যে জীবন মানেই বাস্তবতা মেনে চলা, এবং কিছু কিছু স্বপ্ন সময় নিয়ে পূরণ করতে হয়।
৬. জীবনের উদাহরণ হোন:
একদিন অফিস থেকে ফিরতে ফিরতে রাস্তায় এক রিক্সাওয়ালার কথা শুনলেন ফারহান। সে বলছিল, “ভাই, আমার পোলারে পড়াইতেছি। ও যেন আমার মতো কষ্ট না করে।”
ফারহান হেসে ফেললেন। এই কথা তো সবার মুখে। কিন্তু সন্তানকে সংগ্রাম শেখাতে না পারলে সে বড় হয়ে বাবার কষ্টকে “ডিউটি” ভাববে, “ভালোবাসা” নয়।
আপনি যদি চান সন্তান আপনার কষ্ট বুঝুক, তাহলে তাকে শুধু সুখ না, কষ্টও দেখান। তাকে বোঝান, আপনি অফিসে ১০ ঘন্টা কাজ করেন, শুধু তার পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য। তাকে নিয়ে যান আপনার ছোট অফিসটাতে, দেখান আপনার ডেস্ক, আপনার বস, আপনার লাঞ্চবক্স।
৭. কোথায় শুরু করবেন?
• খোলামেলা কথা বলুন: মাসে একদিন পরিবারের সবাই বসে আলোচনা করুন, এই মাসের আয়-ব্যয় কেমন হচ্ছে। কোন খরচ কমানো যায় কি না, সেটা নিয়েও সন্তানদের মতামত নিন।
• চলমান খরচের হিসাব শিখান: ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই দিন ১০০ টাকা খরচ করতে, বলুন সেটা লিখে রাখতে। পরে দেখান মাসে কতটা খরচ হয়েছে, কোন খরচটা অপ্রয়োজনীয় ছিল।
• অংশীদার করুন: ঈদের জামা কিনতে গেলে বলুন, “আমার বাজেট এই পরিমাণ। তুমি কি এমন কিছু বেছে নিতে পারো, যাতে টাকা বাঁচে?” এতে সে নিজের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতাও বাড়াবে।
• সংগ্রামের গল্প বলুন: আপনি কিভাবে পড়াশোনা করেছেন, প্রথম চাকরি কিভাবে পেয়েছেন, সেসব গল্প শোনান। এতে সন্তান শুধু গর্বই করবে না, শেখেও যাবে।
৮. সন্তান আপনার “বস” নয়, সহযাত্রী হোক
আপনার সন্তান যদি বড় হয়ে ভাবে, “বাবা সব দিতো, মা সব ম্যানেজ করতো,” তাহলে আপনি শুধু দায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু যদি সে ভাবে, “বাবা অনেক কষ্ট করেছে, মা আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন,” তাহলে আপনি একটি মানুষ গড়ে তুলেছেন।
সন্তান আপনার “কাস্টমার” নয়, “সহযাত্রী”—এই জিনিসটা বোঝাতে পারলেই আপনি একজন সত্যিকারের পিতা-মাতা।