কাজের বুয়ার কাহিনীঃ
আমাদের বাসার কাজের বুয়া (৫৪) মাসে ১৭ হাজার টাকা আয় করেন। উনি আমাদের বাসায় সকাল ৯ টায় আসার আগে একটা মেসে রুটি বানান। সেখানে তিনি ভোর ৬ টায় পৌঁছে ৮ টার মধ্যে রুটি বানানো শেষ করে ৯ টার মধ্যে আমাদের বাসায় আসেন। সেই মেস থেকে আমাদের বাসার রিকশা ভাড়া ৪০ টাকা। এই দূরত্ব তিনি হেঁটে হেঁটে আসেন বলেই ৫০ মিনিট লেগে যায়।
-রুটি বানানোর জন্য তিনি মাসিক ২৫০০ টাকা পান ও সকালে নাস্তা সেখানেই করেন।
আমাদের বাসায় ৩টা কাজ করেন- (১) কাপড় ধোয়া (২) ঘর মোছা ও (৩) রাতে ও সকালের ময়লা বাসন কোসন হাড়ি পাতিল ধোয়া। এই ৩ কাজ করতে ওনার ১ ঘন্টা ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগে।
-এই ৩ কাজের জন্য তিনি আমাদের কাছ থেকে ২৩০০ টাকা পান।
এরপরে তিনি চলে যান একটি অফিসে। সেখানে তিনি দুপুরের খাবার রান্না করেন ও সেখানি দুপুরের খাওয়া সেরে নেন। সেখানে তিনি রান্না বাবদ ২৪০০ টাকা (৮ জনের জন্য ৩০০ টাকা করে) বেতন পান। মাসের ১৫/১৬ দিন অফিসের বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়ে উনি রাতের খাবার ম্যানেজ করেন। এই খাবার তিনি বাসায় নিয়ে আসেন।
উপরের ৩ কাজ মিলিয়ে ওনার মাসিক বেতন দাঁড়ায় ৭২০০ টাকা ও প্রায় ৩ বেলা খাবারই ফ্রী অর্থাৎ মাসে ১৫ বেলা ওনাকে নিজ খরচে খেতে হয়। এই ১৫ দিন রাতে উনি নিজেই রান্না করেন।
উনি দুপুরে অফিস থেকে ফিরে বাসায় এসে ঠিক ২ ঘন্টা ঘুমান। বিকালে তিনি মাটির চুলা ও অন্যান্য সরঞ্জামাদী নিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
সন্ধ্যার পরে কোন না কোন রাস্তার পাশে ওনাকে পিঠা বানাতে দেখা যায়। কখনো পিঠা, কখনো পেঁয়াজু ইত্যাদি বানিয়ে সেখান থেকে গড়ে ৩০০ টাকা লাভ বের করেন। অর্থাৎ এই ব্যবসা থেকে ওনার আয় হয় মাসে ৯ হাজারের মত। তবে চাঁদাবাজদের ঝামেলা, পুলিশের হয়রানী ও গোলযোগ পূর্ণ আবহাওয়ার কারণে মাঝে মাঝে তিনি ব্যবসা করতে পারেন না।
বিশেষ করে বর্ষাকালে ওনার ব্যবসা প্রায় বন্ধই থাকে। সে সময় তিনি অবশ্য হোটেলে মশলা বাটার কাজ নেন।
ওনার বিয়ে হয়েছিল ১৬ বছর বয়সে। স্বামী মারা গেছে যখন মেয়ের বয়স ১২ ও ছেলের বয়স ৮। গ্রামে খাবার দাবার না পেয়ে বাচ্চা দুটিকে সাথে করে শহরে নিয়ে এসেছিলেন। ওনার নাতনী এই বছর এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছে।
ওনার কথা বলেছি এই কারণে, উনি প্রতি মাসে ১০ হাজার টাকা জমান। সেই জমানো টাকা দিয়ে প্রতি ৩/৪ মাস পর পর ওনার এলাকার জমি কিনেন। আজ এই জমির বায়না তো কাল সেই জমির রেজিষ্ট্রেশন। এরপরে আরেক জমি বন্ধক দিয়েছেন।
আরেক জমি বন্ধক থেকে ছাড়িয়েছেন। এই কাজ তিনি গত ২৫ বছর ধরে করছেন। ২৫ বছর আগে ওনার আয় কম ছিল, জমির দামও কম ছিল। এখন ওনার আয় বেড়েছে, জমির দামও বেড়েছে।
সম্পূর্ণ খালি হাতে যে মহিলা ২৫ বছর আগে গ্রাম ছেড়েছেন আজ তিনি গ্রামের ৮ বিঘা জমির মালিক। ওনার একটা জমি আছে যেটার মার্কেট প্রাইস এখন ৪৫ লক্ষ টাকা। ২ টা জমি আছে এখন মার্কেট প্রাইস ৩০ লক্ষ টাকা। সেদিন ওনার সাথে হিসাব করে দেখলাম ওনার অর্জিত সম্পদের বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ১ কোটি টাকা!!
জিজ্ঞেস করলাম "এত সম্পদ থাকার পরেও এত কষ্ট করেন কেন?"
উনি উত্তর দিলেন "কষ্ট করতে করতে সহ্য হয়ে গেছে। এখন আর বসে থাকতে ভাল লাগে না। এছাড়া একটা সময় আসবে তখন তো আর কষ্ট করা যাবে না, শরীর কুলোবে না। তাই এখন কাজ করি।"
এই মহিলা ২৫ বছর চাকরি+ব্যবসা করে প্রায় ১ কোটি টাকা সম্পদের মালিক হয়েছে অথচ ১৪ বছর চাকরি করে আমি ফইন্নি ফইন্নিই রয়ে গেলাম। হঠাৎ মনে হল, বয়স এখনো শেষ হয় নি। আমাদের বুয়া ২৯ বছর বয়সে স্ট্রাগল শুরু করে এই পর্যায়ে এসেছে। আমারও তো এখনো অনেক সুযোগ রয়েছে। কাজে লাগাই না কেন?
-- সংগ্রহীত --