১৯৭২ সালে, মিশেল সিফর নামের এক ফরাসি বিজ্ঞানী একটা ভয়ংকর পরীক্ষা চালালেন,
পরীক্ষা চালালেন এমন এক স্থানে যেখানে তিনি সম্পূর্ণ একা, কোনো আলোর প্রবেশাধিকার ছাড়া, ৪৪০ ফুট গভীর এক গুহায় ১৮০ দিন কাটান। কোনো আলো নেই, কোনো সময় গণনা করার উপায় নেই, কোনো মানুষের সংস্পর্শ নেই। এই পরীক্ষার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের মস্তিষ্ক কীভাবে সময়কে উপলব্ধি করে তা বোঝা।
মিশেল সিফর একজন ভূতত্ত্ববিদ ও গবেষক ছিলেন। তিনি মনে করতেন, সময় ও মানুষের মনোজগতের মধ্যে গভীর সম্পর্ক রয়েছে। এটি প্রমাণের জন্য তিনি একটি সাহসী পরীক্ষা চালান। তিনি সিদ্ধান্ত নেন, তিনি সম্পূর্ণ একা একটি গুহায় থাকবেন, যেখানে কোনো ঘড়ি থাকবে না, সূর্যালোকের কোনো চিহ্ন থাকবে না, বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ থাকবে না। বিশ্ববাসীর চোখে এটি ছিল নিছক এক পাগলামি।
১৯৭২ সালে, মিশেল সিফর যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে একটি গভীর গুহায় নেমে যান। তার সঙ্গী ছিল শুধু একটি শয্যা ও বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম। গুহার অন্ধকার ছিল সম্পূর্ণ, শব্দহীনতা ছিল যেন এক ভয়ঙ্কর শূন্যতা।
শুরুর দিকে তিনি খাওয়ার সময় ও ঘুমের সময় ঠিক রাখার চেষ্টা করলেন, শরীরের ক্লান্তি ও ক্ষুধার উপর ভিত্তি করে সিদ্ধান্ত নিলেন কখন বিশ্রাম নেবেন বা খাবেন। কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি তিনি সময়ের বোধ হারিয়ে ফেললেন। ঘণ্টা মনে হতো কয়েক মিনিট, দিনগুলো একসঙ্গে মিশে যেতে লাগল।
একাকীত্ব ও অন্ধকার তার মনে গভীর প্রভাব ফেলতে শুরু করল। তিনি ছায়া ও কণ্ঠস্বরের মত কিছু দেখে ও শুনে বিভ্রান্ত হতে লাগলেন, মনে হতে লাগল, কেউ তার আশেপাশে আছে, তার চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। এই পরীক্ষাটি তার মানসিক শক্তির চরম পরীক্ষা হয়ে দাঁড়ায়।
গুহার ওপরে থাকা গবেষক দল তার কার্যকলাপ পর্যবেক্ষণ করছিলেন। দেখা গেল, তার সময়ের ধারণা পুরোপুরি বদলে গেছে। দ্বিতীয় মাসে পৌঁছানোর পর তিনি ভাবতে লাগলেন, একদিন ২৪ ঘণ্টার পরিবর্তে প্রায় ৪৮ ঘণ্টার সমান। অর্থাৎ, তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ধীর গতিতে কাজ করছিল।
তার শরীর ধীরে ধীরে একটি নতুন রুটিন তৈরি করেছিল—৩৬ ঘণ্টা জেগে থাকা, ১২ ঘণ্টা ঘুমানো। এটি বিজ্ঞানীদের অবাক করে দেয়। মানুষ সাধারণত ২৪ ঘণ্টার জীবচক্র অনুসরণ করে, যা সূর্যালোকের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু সূর্যালোক ছাড়া, মস্তিষ্ক নিজেই নতুন এক সময় গণনা পদ্ধতি তৈরি করেছিল।
দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে তার মানসিক অবস্থা আরও খারাপ হতে লাগল। তিনি মাঝেমধ্যেই শব্দ ভুলে যাচ্ছিলেন, সাধারণ বিষয় মনে রাখতে পারছিলেন না, তার আবেগ অনিয়ন্ত্রিত হয়ে উঠছিল—একবার খুব আনন্দিত, পরক্ষণেই গভীর দুঃখে ডুবে যাচ্ছিলেন।
তিনি একাকীত্ব থেকে মুক্তি পেতে পোকামাকড়ের সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন। নিজের কণ্ঠস্বরই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী।
১৮০ দিন পর, তিনি যখন গুহা থেকে বেরিয়ে আসেন, তার মনে হয়েছিল ১৫১ দিন কেটেছে। তিনি উপলব্ধি করেন, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া মানুষের মস্তিষ্ক সময়ের বোধ পুরোপুরি হারিয়ে ফেলে।
সিফরের এই গবেষণা থেকে আমরা শিখতে পারি, সময় শুধু বাইরের বাস্তবতা নয়, এটি আমাদের মস্তিষ্কেরও সৃষ্টি। একাকীত্ব ও ইন্দ্রিয় বঞ্চনা সময়ের অনুভূতিকে বিকৃত করতে পারে।
তার গবেষণা থেকে নতুন নতুন আবিষ্কার হয়—ঘুমের চক্র ও মানুষের দৈনিক জীবনযাত্রা নিয়ে গবেষণা, মহাকাশে নভোচারীদের মানসিক প্রস্তুতি, বন্দিদের ওপর একাকীত্বের প্রভাব।
এই পরীক্ষা তার জীবনকে চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছিল। তার স্মৃতিশক্তি স্থায়ীভাবে দুর্বল হয়ে যায়, মানসিকভাবে সুস্থ হতে তার অনেক বছর লেগে যায়। তিনি গুহায় কাটানো দিনগুলোকে "একটি অন্তহীন রাত" হিসেবে বর্ণনা করেন।
তবুও, তিনি থেমে থাকেননি। তিনি আরও কয়েকবার একই ধরনের পরীক্ষা চালান, আরও গভীর গবেষণার জন্য।
তার কাজ আমাদের শেখায়—সময় শুধু বাইরের কোনো বিষয় নয়, এটি আমাদের মনের ভেতরেই গড়ে ওঠে।
"মানব মস্তিষ্ক নিজেই এক বিশাল মহাবিশ্ব।" – মিশেল সিফর
লেখাটি ভালো লাগলে শেয়ার করতে ভুলবেন না।